বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের প্রায় প্রত্যেকটি খেলোয়াড়েরই দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করার ইতিহাস। তেমনই এক মহিলা ফুটবলার ঐশী খাতুন। অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা ফুটবল দলের হয়ে এবারের সাফে অংশ গ্রহণ। একাদশে সুযোগ পেয়েই তার জোড়া গোল ছিল ভুটানের বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে ৯০ মিনিটের সময় মাঠে নামেন বদলি হিসেবে। তবে মেয়ের খেলা নিজ বাড়িতে বসে দেখার সুযোগ হয় না ঐশীর পরিবারের। নিজেদের যে টেলিভিশন নেই। ফলে পাশের বাড়িতে গিয়েই মেয়ে ঐশীর খেলা দেখেন তার বাবা-মা।
গত বছর থেকেই বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে এই মিডফিল্ডার। খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ সাফ এবং অনূর্ধ্ব-১৭ এএফসি মহিলা ফুটবলের প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ড। এই প্রথম গোল পেলেন সুন্দরী এই ফুটবলার।
ঝিনাইদহের মেয়ে ঐশী। বাবা দরিদ্র কৃষক। ফলে তার পক্ষে টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু মেয়ের খেলা বলে কথা। তাই পাশের মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে মেয়ের খেলা দেখেন তার মা ও একমাত্র বোন। আর বাবা বাজারে অন্যের দোকানে খেলা দেখতে ছুটেন। তা ২০২২ সালের অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ ফুটবল থেকে। তথ্য দেন ঐশী।
স্কুলের কোচ রবিউল ইসলাম এবং সেজ চাচার প্রচেস্টাতেই ঐশী খাতুন এখন ফুটবলার। ফুটবলে আসা বঙ্গমাতা আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় আসরের মাধ্যমে। খেলেছেন ঝিনাইদহের শৈলকূপার দোহারু মডেল সরকারি স্কুলের হয়ে। সেখানে তার গোল ছিল। ছিল হ্যাটট্রিকও।
ঐশী জানান, ‘আমি প্রথমে রাইট উইংয়ে খেলতাম। এরপর ২০১৯ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর কোচ জয়া চাকমা (একই সাথে ফিফা রেফারি) আমাকে মিডফিল্ডে নিয়ে আসেন। উনি আমাকে স্পেশাল কিছু ট্রেনিং করাতেন। বুঝতাম এটা আমার উন্নতির জন্যই।’
এখন তিনি বাংলাদেশের বয়স ভিত্তিক জাতীয় দলের খেলোয়াড়। এ পর্যন্ত আসার জন্য বারবারই তিনি উল্লেখ করলেন রবিউল স্যার ও সেজ চাচার কথা। জানান, আমার ঢাকায় আসার গাড়ি ভাড়াসহ যাবতীয় খরচই বহন করেন চাচা। আর আমি যখন পাসপোর্ট বানাই সে টাকা দিয়েছেন আমার রবিউল স্যার।’
আর ফুটবলে এতদূর আসার জন্য বিকেএসপির কোচ জয়াসহ মহিলা জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন, সহকারী কোচ লিটু, অনন্যা, বর্তমান কোচ সাইফুল বারী টিটু এবং বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জানান, ‘এক কোচের অধীনেতো সব কিছুতে উন্নতি হয় না। সবার কাছেই শেখার আছে।’
বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ, অনূর্ধ্ব-১৭ এএফসি ফুটবলের প্রাথমিক ও দ্বিতীয় রাউন্ড খেলেছেন। এএফসির আসরে খেলতে গত বছর সফর করেছেন সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে। তবে তার আফসোস ভারতের সুব্রত কাপে খেলতে না পেরে। তার দেয়া তথ্য, ‘আমি সুব্রত কাপে খেলার জন্যই বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে খেলা হয়নি। গত বছর একইসাথে এএফসির আসর ও সুব্রত কাপ হওয়ায় আমাকে জাতীয় দলকেই পছন্দ করতে হয়। আর এখন সুব্রত কাপ খেলার মতো বয়সও নেই।’
বিদেশ সফরে গিয়ে ভুলে যাননি ছোট বেলার কোচ রবিউলকে। তার জন্য উপহার এনেছেন সিঙ্গাপুর থেকে।
দুই বোনের মধ্যে ঐশীই বড়। টিভিতে তার খেলা দেখালে মা ও ছোট বোন চলে যান পাশের বাড়িতে। ‘পাশেই মেম্বার দাদুর বাসায় বসেই টিভিতে আমার খেলা দেখেন মা ও বোন। আর দরিদ্র কৃষক বাবা অন্যের দোকানে থাকা টিভিতে মেয়ের খেলা উপভোগ করেন।’ বলেন তিনি।
এবার অনূর্ধ্ব-১৯ সাফে অন্যের টিভিতেই মেয়ের খেলা এবং গোল উপভোগ করেছেন ঐশীর বাবা-মা। এই উঠতি ফুটবলার জানান, এই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল পেয়েছি। এক ম্যাচে দুই গোল। এতে আমি যেমন খুশি। তেমনি বাবা-মাও যথেষ্ট খুশি। আমার হেডের গোলে কোচ টিটু স্যার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
২০২২ সালে অল্পের জন্য বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। শেষ ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে জয়নব বিবি রিতার পেনাল্টি মিসই লাল সবুজদের শিরোপা উৎব করতে দেয়নি। ট্রফি জেতা হয়নি বলে অর্থ পুরস্কারও জোটেনি ঐশীদের। তবে এবার ভারতের সাথে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অর্থ পুরস্কার মিলবে। এমন আশা ঐশীর। ‘টাকা পেলে তা তুলে দেবো বাবা-মায়ের হাতে।’ বললেন ঐশী।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...