রণজিৎ মোদক : স্বপ্ন দেখার চেয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা কঠিন। একজন স্বপ্ন পুরুষ হিসেবে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ১৩ শতাংশ ২৭ সালের ২০ চৈত্র মঙ্গলবার রাত ৮টায় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রায় তিনশত বছর পূর্বে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য শেখ বংশের আদি পুরুষ শেখ আওয়াল সুদূর ইরাক থেকে চট্টগ্রামে আসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাদার নাম শেখ আব্দুল হামিদ। বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান মায়ের নাম সায়রা খাতুন। স্বপ্নপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের প্রেরণাদাত্রী তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেনু।
১৯২৭ সালের গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা এবং বাঙালি জাতির সুখ স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন ছিল কণ্টকাকীর্ণ। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা। ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মূল ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা দাবি। ১৯৬৬ সালে ৮মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। আন্দোলন আরো ঘনীভূত হতে থাকে। বৃদ্ধি পায় জনতার উপস্থিতি।
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামী করে মোট ৩৫ বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু সহ অন্যান্য আসামীদের মুক্তিদানে বাধ্য হয়। সেসব ইতিহাস আজ সবার জানা।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিরাট সংবর্ধনা প্রদান করেন। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বহু ঘটনাবহুল জীবন হচ্ছে মুজিব।
হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্বপাকিস্তানের নামকরণ করেন বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে জয়লাভ করে। তারপর শুরু হয় পাকিস্তানি কূটচাল। বাঙালি নিধনযজ্ঞের ষড়যন্ত্র। মাঠের কৃষক থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সর্বস্তরের মানুষ বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। সংগ্রামে-সংকটে রাজপথে নেমে আসেন বাংলার মানুষ। ‘আমার তোমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ ‘আমি কে, তুমি কে বাঙালি বাঙালি স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত।’ প্রাইমারি বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র হাটে-মাঠে-ঘাটে, মিল-কারখানা ও অফিস-আদালত সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে স্বপ্নপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ন্যাপ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে সমর্থন জানান। পাকিস্তানি নরখাদক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে ১৭ মার্চ অস্ত্র বোঝাই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান নেয়। সেখানে অস্ত্র খালাস করতে বাধা দান করে শ্রমিক জনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত এগারোটায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়। আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু অস্পষ্ট ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন আমার দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে ধানমন্ডি ৩২নং সড়কের ১০ নং বাড়ি থেকে অপারেশন ‘বিগ বার্ড’ অভিযান চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন- চট্টগ্রাম রক্তের বন্যা বয়ে যায়। শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। স্বাধীনতার পক্ষের ২৬ মার্চ দুপুরের মধ্যে চট্টগ্রাম কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আ¤্রকাননে ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়। দুই শতাধিক বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া-মেহেরপুর আ¤্রকাননে বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীনতা স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আসাম, মেঘালয়, আগরতলা ও বিহারের ৯৩৫টি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে ৯১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩২ জন বাংলাদেশি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অর্জিত হয় বাঙালির বিজয়। ৩০ লাখ বাঙালির রক্ত ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীনতা।
মূলত বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। এইদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে দৃঢ়তার সাথে উনয়নমুখী পথে দাড়া করান। স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি ও বহির্বিশ্বের অস্ত্রবাজ স্বার্থান্বেষী মহল এসব ভালো চোখে দেখেনি। শুরু হয় ষড়যন্ত্র, দেশে-বিদেশে গোপন ষড়যন্ত্র চলে। ভারতীয় ‘র’ এ বিষয়টি প্রথমে ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করেন। পরে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানকে অবহিত করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিষয়টি বিশ্বাস করেননি। তিনি বলেন, বাঙালিরা আমাকে হত্যা করতে পারে না। বাংলা এবং বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর হৃদয় নিংড়ানো বিশ্বাস ছিল। এই বিশ্বাস-ই তার কাল হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে একদল বিপথগামী সৈন্য ৩২নং ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে ঘাতকেরা বুলেটের আঘাতে হত্যা করে। ঘাতকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে সব শেষ হয়ে যাবে। না, বঙ্গবন্ধুকে ওরা হত্যা করেছে কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি ঘাতকরা। বরং ঘাতকরাই আজ মৃত্যু ভয়ে অনেকে পলাতক রয়েছে। বিশ্বের মানুষ সমাজ তাদের ঘৃণা দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের আদর্শ নেতার যোগ্য উত্তরসূরি বঙ্গকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনার বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের লক্ষ্যে। প্রশংসিত হচ্ছে দেশ-বিদেশে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন। কারণ বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ একটি আদর্শের নাম।
লেখক-
রণজিৎ মোদক
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...