রণজিৎ মোদক : প্রত্যেক শিশুর অন্তরে স্বপ্ন লুকিয়ে রয়েছে। ফুলের কলির মাঝে পাপড়ী ঘেরা সুগন্ধ লুকানো থাকে। তাই কবি বলেছেন, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে। অন্তরের লুকায়িত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখা স্বপ্ন নয়। জেগে থেকে মানুষ অন্তরের যে স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্ন হচ্ছে আসল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে চাই পরিবেশ ও শিক্ষা। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করা চাই।
অনেক অভিভাবকদের অভিযোগ তাদের সন্তানরা পড়াশোনায় তো তেমন মন দিচ্ছে না। বারবার তাগিদ দিয়ে পড়ার টেবিলে বুঝতে চাচ্ছে না। পড়ার প্রতি কেন জানি অনীহা। বই পড়ার আনন্দ তারা যেন তাদের অন্তরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। বই থেকে দূরে সময় কাটাতে পারলেই যেন বাঁচে। মূল বই না পড়ে শুধু শুধু নৈবিত্তিক উত্তরপত্রে ঠিকঠাক টিক দিয়ে নম্বর দিলেই যেখানে পাস। সেখানে মূল প্রবন্ধ গল্প কবিতা পড়বে কে? যাদের মধ্যে জ্ঞানের পিপাসা বা জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তারা অবশ্যই ধানের মত বইয়ের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে ৮০ হাজার বই ছিল। আর তার প্রিয় ছাত্র ডঃ শহীদুল্লাাহ জ্ঞানতাপস পড়ার সময় নষ্ট হবে বিধায় দাড়ি শেভ হতেন না। এজন্য তার মা তাকে প্রশ্ন করে বলতেন মা যতক্ষণ দাড়ি শেভ করে সময় নষ্ট করব ততক্ষণে একটি পড়া পড়তে পারি। তিনি চল্লিশটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। সব সময় বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতেন। তিনি অনুভব করেছিলেন স্বাস্থ্য নষ্ট হলে ফিরে পাওয়া যাবে কিন্তু সময় নষ্ট তা ফিরে পাওয়া যায় না।
আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় দীর্ঘ এক বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর মূল্যবান জীবন থেকে পরিস্থিতির কারণে একটি বছর চলে যাচ্ছে। জীবনের খাতা থেকে একটি বছর বিয়োগ হয়ে যাওয়া কত যে বেদনা আর তা বলে শেষ করা যাবেনা। পরিস্থিতি পরিবেশ মানুষকে অনেক সময় বাধ্য করে সবকিছু মেনে নেয়ার। আপনি কি বলতে পারবেন আপনার সন্তান করোনাকালীন সময় কয় ঘন্টা পড়ার টেবিলে বসেছে? আসল কথা আপনার সন্তানের অন্তরে গানের পিপাসা জাগ্রত করা হয় নাই। তবে যাদের অন্তরে গানের পিপাসা জাগ্রত হয়েছে তারা ঠিকই সময়কে কাজে লাগিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয় উত্তরণের উপায় কি? এ নিয়ে দেশে বিজ্ঞজনেরা অবশ্যই ভাবছেন। জীবন বাঁচাতে এগিয়ে সরকার বিচক্ষণতার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন আমার সন্তানদেরকে আমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারিনা। একজন মা তার সন্তানদের মঙ্গল সর্বদাই কামনা করেন। এখানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে ধন্যবাদ জানাই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে সরকার চিন্তা করছেন। সরকার নিয়মিত শিক্ষক বেতন বোনাস দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া সারাদেশে ৪০ লাখ ছাত্র ছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা নিজ নিজ একাউন্টে প্রদান করেছেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাসের পাশাপাশি পাঠ নিশ্চিত করতে নিয়মিত ফলোআপ লক্ষ্য করছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে প্রশ্নপত্র অভিভাবকের মাধ্যমে তুলে পরীক্ষা নিচ্ছেন। তবে এতে কতটুকু মূল্যায়িত হবে আমি জানি না। মূলকথা ছাত্র-ছাত্রীদের বইমুখী করার এক অভিনব প্রয়াস। ইদানিং অটোপ্রমোশন নিয়ে নানা ধরনের কথা উঠেছে। কথা যাই উঠুক ছাত্র-ছাত্রীদের একই শ্রেণিতে ধরে রাখা হলে তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। অপরদিকে আগামী কর্মজীবনে বয়স বিড়ম্বনা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিবে। মানুষের জীবন কত দিনের? একটি বছর। অনেক দিন অনেক সময়। করোনা মুক্ত পরিবেশে আমাদের ছাত্র-ছাত্রী নতুন উদ্যমে শিক্ষা পথে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। আগামীতে ৪০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। করোনাকালীন সময় অনেকের পরিবারের মধ্যে দারিদ্রতা স্থান করে নিচ্ছে। যদিও সরকার বিভিন্ন ভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। তারপরেও অনেক ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান না থাকায় বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা যেন কাউকে ক্ষমা করছে না। সামনের শীত সিজন তাই সবাইকে আগাম সতর্ক করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সবাইকে মাক্স ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। জ্ঞানী দূরদর্শীর হীত উপদেশ মেনে চলাই উত্তম।
কিন্তু সময় এবং স্রোত কোনটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। সময় এবং স্রোতকে যারা ব্যবহার করতে পারেন তারা সত্যিই লাভবান হয়ে থাকেন। বর্তমানে স্কুল বিমুখ ছাত্র-ছাত্রী মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট মুখী হয়ে পড়েছে। তাদের বই বা পাঠ্যমুখী করা বায়ুুকে বশ করার ন্যায় কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সামনে যে কি আদর্শ তা অনেক ছাত্র-ছাত্রী জানেনা। অভিভাবকদের জানাতো প্রশ্ন রয়ে যায়। মহৎ লোকের মহৎ কর্ম থেকে আমরা আদর্শ গ্রহণ করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলায় সোনার মানুষ গড়ার জন্য সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তার প্রাণের গড়া ছাত্রলীগ যাদের নামে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ছাত্রলীগের কতিপয় নামধারীদের কর্মকাণ্ড জাতিকে ব্যথাতুর করে তুলছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে ছাত্রলীগ। এতে করে সমস্ত বদনাম গুলো আওয়ামী লীগ সরকারের উপর পড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীরা আগুনের আফরে বাতাসের ফুঁ দিচ্ছে। আর সত্যিকারের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা লজ্জায় ম্রিয়মান হয়ে পড়ছে। এ লজ্জা থেকে মুক্তি দিতে একমাত্র ছাত্রলীগকেই এগিয়ে আসতে হবে।
আমি একবার নারায়ণগঞ্জ মিশনপাড়া ডক্টর সৈকত আজগর স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম অনুপ্রাস সাহিত্য সভার নিমন্ত্রণ করতে। তার রুমে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হলো এজন্য একটি বইয়ের লাইব্রেরী। মাঝখানে চেয়ার-টেবিল চারদিকে বইয়ের তাক সাজানো। টেবিলে একগাদা সাদা কাগজ। চেয়ারটার হাতল বাহুর ঘর্ষনে ক্ষয় হয়ে গেছে। আমি ২০১০ সালে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি দর্শন করতে যাই আমার সাথে আমার স্ত্রী ছিল। এযেন এক গ্রন্থাগার। যেখানে বাংলাদেশের দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকা সংরক্ষিত দেখলাম। মনটা ভরে গেল। জ্ঞানীর বাসাবাড়ি যেন জ্ঞানের ভান্ডার। বাসাবাড়িতে ফুল বাগানে লাইব্রেরী নেই অনেকে তাদের সাথে আত্মীয়তা করতেন না। পুস্তক সংগ্রহ এবং পুস্তক পাঠের যে আনন্দ তা আজ আমাদের সন্তানরা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের মধ্যে মোবাইল প্রেম চতুর্থ গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল প্রেম আমাদের সন্তান বা জাতিকে কতদূর নিয়ে যাবে তা ভবিষ্যতে বলতে পারবে। আমরা ভালকে তেমন গ্রহণ করি না তাই ভয় হয়। বোমা আবিষ্কার করা হয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, আজ সেই বোমা মানুষ হত্যার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনার জন্য আর কতদিন আমাদের বিদ্যার্থীদের ঘরের মধ্যে পোল্ট্রি মোরগের ন্যায় ধরে রাখতে হবে জানিনা। ঘরে থেকেও যদি বইপ্রেমী হত তবে কোন দুঃখ ছিল না। নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুঠারাঘাত করো না। এ আঘাতের বেদনা আগামীতে নিজেরাই নয় শুধু সমগ্র জাতি ভোগ করুক এ কারো কাম্য নয়। সমগ্র জাতি তাকিয়ে রয়েছে শুধু তোমাদের পানে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশায়।
লেখক-
রণজিৎ মোদক
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...