ফতুল্লা থানার বিভিন্ন এলাকায় উঠতি বয়সী কিশোররাই এখন ফতুল্লাবাসীর আতংকের কারণ হয়ে উঠেছে। তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ ফতুল্লাবাসী। অতিতের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এখন সরাসরি অপরাধের জন্ম না দিলেও উঠতি বয়সী কিশোরদের ব্যবহার করে নানা অপরাধের জন্ম দিয়ে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করছে।
অপরদিকে উঠতি বয়সী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সঠিক তালিকা প্রশাসনের হাতে না থাকায় প্রশাসন ও নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা মামলা ব্যাতিত তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারছেনা। আর এ সুযোগে থানার প্রতিটি এলাকার কিশোর গ্যাং সদস্যরা হয়ে উঠেছে অতিমাত্রায় বেপরোয়া। শীর্ষ কিংবা তারকা সন্ত্রাসী নয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাই এখন স্থানীয়বাসীর নিকট মূর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে।
ধর্ষণ, খুন, মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ সমাজ বিরোধী নানা অপকর্মের সাথে সক্রিয় থেকে চায়ের দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়ক, বিভিন্ন অলিগলি, হোটেল-রেস্তোরাগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক দলের সদস্য অবস্থান গ্রহণ করে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে থাকে এবং দল বেধে মোটর বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। চায়ের দোকানগুলোয় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আড্ডায় মেতে থাকে। আর স্কুল-কলেজের ছুটির সময়ও এদের উৎপাতে অস্থির হয়ে ওঠেন সেখানে আগত অভিভাবকরা। এখন করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও রাস্তাঘাটের নিরিবিলি পরিবেশকে তারা মুহূর্তেই অশান্ত করে তোলে। এমনই নানা অভিযোগ স্থানীয়দের।
তথ্যমতে, এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ফতুল্লা রে স্টেশন এলাকায় ও শাহজাহান রোলিং মিলস এলাকায় পরপর দুটি গণধর্ষণের ঘটনার জন্ম দেয়। তবে প্রশাসনের তৎপরতায় ঘটনার পরপরই জড়িতরা গ্রেফতার হয়।
বিশেষ করে শাহজাহান রোলিং মিলস এলাকায় সংঘটিত হওয়া গণধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িত ছয় ধর্ষককে ঘটনার ৮ ঘন্টার ব্যবধানে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। লকডাউনের শুরুর দিকে দেওভোগ এলাকায় সংঘটিত শরীফ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো একদল কিশোর। ঘটনার রাতেই ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ জড়িত বেশ কয়েক ঘাতককে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। গ্রেফতারের পর তারা হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দীও দেয়। এছাড়া কিশোর গ্যাং সদস্যরা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় জড়িয়ে পরছে বড় ধরনের সহিংস ঘটনায়।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ শীর্ষ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের ভয়ে এখন আর নিজেরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে না। তবে তারা উঠতি বয়সী কিশোরদের ব্যবহার করে তারা জন্ম দিচ্ছে একের পর এক অপরাধ।
পাগলা রেললাইন বটতলা এলাকার এক চায়ের দোকানদার এ প্রতিবেদককে বলেন, বেশকিছু কিশোর তার দোকানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে থাকে। কিছু বললেই তাকে মারতে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানে বসে থাকে। ছোট্ট বাচ্চা। বয়স মনে হয় ১৫-১৬ বছর হবে। আর এরাই একটার পর একটা সিগারেট টানে। কোনো মুরব্বিও মানে না। যতক্ষণ থাকে তাদের দখলে চলে যায় দোকানটা। তিন-চারজন নয় একসঙ্গে আট-দশজন এসে আড্ডা মারে। এক গ্রুপ চলে গেলে আরেক গ্রুপ এসে আড্ডা মারে। কখনো কখনো আড্ডা নিয়েও তাদের মধ্যে মারামারির মতো ঘটনাও ঘটে। আর এমনই একটি হত্যার ঘটনা ঘটেছিলো গত একবছর পূর্বে ফতুল্লা রেললাইন বটতলা এলাকায়।
জানা যায়, কিশোরদের এই গ্রুপগুলো ফতুল্লায় বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। একেক জায়গায় একেক গ্রুপ বসে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন করে আসে। চায়ের দোকানে ভিড় করে হই-হুল্লোড় করেই ক্ষ্যান্ত হয় না কিশোর গ্যাংয়ের ওই দলগুলো। ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায় বেড়াতে আসা সাধারণ মানুষদেরও উত্ত্যক্ত করে তারা। বিশেষ করে কোনো প্রেমিক যুগলকে একসঙ্গে বসে গল্প করতে দেখলে নানাভাবে বিরক্ত করে। এতে কেউ ক্ষিপ্ত হলে তার ওপর চড়াও হয়।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একদল কিশোর যাদের বয়স ১৬-১৭ বছর। কারো পরনে পাঞ্জাবী। আবার কেউ সাধারণ পোশাকে। ফতুল্লা রেলস্টেশন দিয়ে শাহজাহান রুলিং মিল এলাকার রেললাইনের দিকে একটু এগিয়ে দেখা মেলে তাদের। একসাথে প্রায় ১৫-২০ জন দল বদ্ধ হয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশ্ববর্তী এক চটপটি ব্যবসায়ী জানান, প্রায়ই তার দোকানে এসে আড্ডা দেয় কয়েকটি গ্রুপ। তবে একাধিক গ্রুপ একসঙ্গে আসে না। তাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে কেউ কারো সামনে আসে না। এদের মধ্যে মারামারির ঘটনা হয়। মাঝে মাঝে এই রাস্তার উপরই মারামারি শুরু করে।
মারামারির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই চটপটি ব্যবসায়ী বলেন, কি নিয়ে মারামারি হয় সেটা তাদের আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। তবে একই এলাকায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ হওয়া নিয়ে মারামারি বাঁধে। কয়েকবারই দোকানের সামনে এসে মারামারি করেছে। মাঝে মাঝে তাদের এসব কাণ্ড দেখে ভয়ে অনেকে এখানে বসতে চান না। এদিকে থানার বিভিন্ন এলাকার মতো কিশোর গ্যাংগুলোর আতংকে আতংকিত দাপা ইদ্রাকপুরবাসী।
এ সকল কিশোর গ্যাং সদস্যরা কোনো প্রকার কারণ ছাড়াই মিথ্যা অজুহাত তৈরী করে মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার মতো অপরাধ খুব সহজেই করে থাকে। কিশোর গ্যাংয়ের প্রতি এলাকার শীর্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক বড় ভাই এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আর্শীবাদ থাকায় প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পর্যন্ত কেউ করে থাকেনা।
ফতুল্লা রেললাইন বটতলা থেকে ইসদাইর বটতলা রেলপথের রাস্তাটি অনেকটাই ফাঁকা থাকে প্রায় সময়। এই জায়গাগুলোতে সন্ধ্যার পর আড্ডা জমায় ১৫-২০ জনের মতো কিশোররা। মাঝে মাঝে তারা এলাকার মধ্যে হট্টগোল বাধিয়ে দেয়। আশপাশের চলাচলকারী অনেকেই তাদের ঝামেলার কারণে পথ চলতে অসুবিধায় পরেন। বেশিরভাগ সময় এদের একগ্রুপ আরেক গ্রুপের মধ্যে মারামারি করে। একপর্যায়ে কেউ কেউ মারাত্মকভাবে জখম হতেও দেখা যায়। আর এ সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী। এরকম ঘটনা শুধুমাত্র একটি এলাকাতেই নয় থানার প্রতিটি এলাকাতেই কিশোর গ্যাং সদস্যরা হার হামেশা জন্ম দিচ্ছে সমাজবিরোধী নানা অপরাধমুলক কর্মকান্ড।
কিশোর গ্যাং সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসলাম হোসেন জানান, ইতিমধ্যেই ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছে। শুধু তাই নয় প্রতিটি পাড়া মহল্লার কিশোর গ্যাং সদস্যদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অচিরেই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...