শূন্য দশকের শেষভাগে ‘কালোমেঘ’ নামের যাপিতজীবনের সরলচিত্রের আস্ত এক উপন্যাস নিয়ে আত্মপ্রকাশ আহমেদ রউফের। সেসময় ত্রাহি ত্রাহি সাহিত্যরথীর ভীড়ে যারা নিজেদের মেলে ধরার প্রত্যয়ে অটল ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগন্য এই তরুণতম কথাসাহিত্যিক, প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। জটিল কিংবা অতিসাহিত্যের পাশ কাটিয়ে লিখতে লিখতে একদিন যিনি নিজের নামটি ছড়িয়ে দিলেন, এমনকী গদ্য-পদ্য-সম্পাদনায়, রকমারি উপস্থাপনায়, সহজিয়া রউফ।
লেখালেখির চিরহরিৎ ভুবনে একসময় রউফের পরিচিতি হলো, বই বেরুল, এরপর সাহিত্যসংশ্লিষ্ট বন্ধুও সৃষ্টি হলো। নিরলস-নিবেদিত চর্চা, ধারাবাহিক বই প্রকাশ, শিল্পের অমসৃণ পথে পদচারণা তাকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে প্রকাশক হিসেবেও তিনি সৃজনশীলতার পরিধি ছাপিয়ে নিজের মেধা ও যোগ্যতার সাক্ষর রেখেছেন, রেখে চলেছেন। সাহিত্য অনুরাগীদের মননে রউফ দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে নিজেকে মেলে ধরতে চাইছেন।
প্রথম বই এবং অন্যান্য ফ্ল্যাশব্যাক
শূণ্য দশকের শুরু থেকেই শিল্প-সাহিত্যের দিকে ঝুকে পড়ি। টানা দেড় দশক শুধু ছুটে বেরিয়েছি দেশের আনাচে-কানাচে। সৃষ্টি-সৃজনে মগ্ন মানুষের সান্নিধ্য আনন্দের সর্বোৎকৃষ্ট উপলক্ষ তখন। বিশেষ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জকে একই মিশ্রণে ফেলে কাজ করেছি কখনও লেখক হিসেবে কখনও কর্মীর মতন, একটানা। সাহিত্যকর্ম যখন জীবনের একমাত্র উল্লাসÑ একদিন হঠাৎ পরিচয় কিশোরগঞ্জের ছেলে আহমেদ রউফের সঙ্গে। রউফ তখন নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় একজন লেখক-বড়ভাইয়ের সহযোগিতায় নিজের লেখা প্রথম বই বের করে বগলে নিয়ে ঘুরছেন।
কর্মসুত্রে রউফ নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছেন দীর্ঘ দুই দশক এবং বর্তমানে জোরালোভাবে থিতু হয়েছেন। ‘কালোমেঘ’ বইটির গুণগত মান মন:পুত না হওয়ায় রউফের মনখারাপ। ২০০৯ সালে বইটির পুনঃমুদ্রণ প্রকাশিত হয় আমার উৎসাহে। পরবর্তীতে প্রতিবছর নতুন নতুন বই বের হতে লাগল। আহমেদ রউফ লেখালেখি নিয়ে আরও বেশি সিরিয়াস হতে লাগলেন। মূলত, ভাতৃস্থানীয় বাংলাবাজারের কয়েকজন প্রকাশককে রউফের ব্যাপারে জানাই এবং বইপ্রকাশে আগ্রহী করে তুলি। তারাও সম্পর্কের মূল্যায়ণে আন্তরিকতার সঙ্গে আবদার রক্ষা করেন। তরুণ লেখক হিসেবে প্রকাশক ভাইগুলোর কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা তখন রীতিমতো ঈর্ষনীয়।
একইসঙ্গে জাতীয় দৈনিক, লিটলম্যাগ ও বিভিন্ন সাময়িকীতে রউফ ছড়া-কবিতা, কোথাও ছোটগল্প লিখতে থাকেন।
আহমেদ রউফের লেখা প্রকাশিত মৌলিক বইয়ের সংখ্যা পনের অধিক, সম্পাদনা করা বইযোগ করলে এই সংখ্যা দীর্ঘ হবে। ব্যক্তিগত ভাবে তার কিছু বই এবং লেখা আমার কাছে ভাল লাগে। ‘নৈঃশব্দের ডাকঘরে কবি’, ‘মায়াবীনি’, ‘নীল জোছনায় প্রেম’, ‘হলুদেপাখি ও মেঘবুড়ো’, ‘ধনু নদের জ্যোৎস্না যুবক’, ‘তুমি’ প্রভৃতি। বইগুলো পড়লে আহমেদ রউফের লেখকসত্তা অনুধাবিত হবে। সাদামাটা ঢংয়ে গল্প বলার একটা প্রচেষ্টা তার লেখনীর নিজস্বগুণ। যদিও সাহিত্যের সব শাখায় লেখার প্রয়াশ লেখকের, তবে প্রকাশিত বইয়ের সিংহভাগই উপন্যাস ও ছোটগল্পের। একসময় ‘ছোটগল্পকার’ তকমা লাগে নামের পাশে। কাছের লোকজন আনন্দছলে কথাসাহিত্যিক বলেও টিপ্পনী কাটেন।
সাহিত্যচর্চার সাতসতেরো
নারায়ণগঞ্জ অবস্থান করেই ধীরে ধীরে শিল্পসাহিত্যের সভা-সেমিনারে নিয়মিত হন রউফ। কখনও ঢাকায় ছোটেন তো কখনও কিশোরগঞ্জে। ‘অনির্বাণ’ নামের ছোটকাগজ বের করে আরও কিছু লেখকের কাছে পৌছে যান রউফ। অংশগ্রহণ করেন জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের সম্মেলনে। মৌলিক বইয়ের পাশাপাশি আহমেদ রউফ সম্পাদনা করেছেন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই। ‘কিশোরগঞ্জের লেখক অভিধান’, ‘তোমার আমার গল্প’, ‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’ ইত্যাদি বই সমাদৃত হয় সর্বমহলে। ইটনার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলহাজ্ব শাজাহান মিয়া স্মৃতি গণপাঠাগার’। নিয়মিতভাবে সম্পাদনা করেন সাহিত্যের কাগজ ‘রৌদ্রছায়া’। লেখালেখি করে পেয়েছেন স্মারক ও সম্মাননা।
রৌদ্রছায়ার পান্থজন
ছোটগল্পকার আহমেদ রউফ ঘরে থাকা ল্যাপটপে একসময় নিজেই ডিজাইন করতে শুরু করেন সম্পাদিত কাগজটি। পরে একই নামে ‘রৌদ্রছায়া প্রকাশন’ এর মাধ্যমে শুরু করেন বই প্রকাশের কাজ। লেখক বনে যান প্রকাশক— ভাবতে ভাল লাগে নতুন এবং নবীন অনেক লেখক রৌদ্রছায়ার ব্যানারে নিজেদের পা-ুলিপিকে বই আকারে বাজারে আনছেন। নিয়মিত বইমেলায় অংশগ্রহণ, জেলার শ্রেষ্ঠ প্রকাশনীর পুরস্কার প্রাপ্তি, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আয়োজন ইত্যাদি কর্মকান্ড রৌদ্রছায়াকে বিগত দিনগুলোতে পরিচিত করে তুলেছে। প্রকাশক হিসেবে আহমেদ রউফের বিচক্ষণতা, বইয়ের গুণগত মান তাকে কিঞ্চিৎ হলেও আলাদা করেছে প্রায় আদিলগ্নেই। লেখক, প্রকাশক হিসেবে তিনিও হয়ে উঠেছেন সর্বজনবিদিত।
এবং জন্মদিনের গ্রিটিংস কার্ড
এখন লেখক, সম্পাদক ও প্রকাশক আহমেদ রউফের চারপাশে অনেক বন্ধু। চৌদ্দই জুলাই এই বিশিষ্ট লেখকের তেতাল্লিশতম জন্মদিন। লেখকের আইডেন্টিটি তার সেরা লেখাটি। আগামীতে তিনি আরও বেশি অদেখা, অধুনা জগতের নন্দন ব্যাখা করবেন স্বীয় কর্মের মাধ্যমে। প্রকাশক হিসেবে হবেন আরও সুসংহত। একজন লেখক এবং সাহিত্যকর্মী হিসেবে যৌথ অভিধায় এগিয়ে থাকবেন রউফ। এই মাহেন্দ্রক্ষণ ফিরে ফিরে আসুক। একজন বন্ধু এবং সাহিত্যে সতীর্থ হিসেবে এটুকুই প্রার্থণা।
থ্রি চিয়ার্স ফর আহমেদ রউফ।
শুভ জন্মদিন।
লেখক : ছড়াকার ও নির্মাতা
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...